প্রতিটি মুসলিম তো অবশ্যই, ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহী প্রতিটি মানুষের তার সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। যদিও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং সাহাবাদের সীরাত পাঠ করা অনেকেই তার সম্পর্কে জানে না, আর যারা জানে তাদের বেশীরভাগ লোকের কাছেই তার তেমন একটা সিগ্নিফিকেন্স নেই, তাদের কাছে তিনি পরিচিত রাসুল (সাঃ) এর পিতার দাসী হিসেবে। বলছি বারাকাহ উম্মে আইমান- এর কথা। তিনি একমাত্র মানুষ যিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত তার সাথে ছিলেন।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনে বারাকাহ উম্মে আইমানের আগমন তার ধরায় আগমনের পূর্বেই। রাসুল (সাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ বিয়ের আগেই দাস হিসেবে বারাকাহকে নিয়ে আসেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন তার মায়ের গর্ভে তখন তার পিতা ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়া গমন করেন। এই সময় থেকেই মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তার গর্ভধারীনি মা, আমেনার সেবার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন বারাকাহ উম্মে আইমান। সদ্য বিবাহিতা আমেনার স্বামী বিহনের শোকের সংগীও হন বারাকাহ।
মাস খানেক পর মদিনা থেকে আব্দুল্লাহর মৃত্যুর খবর এল। এই খবর আমেনার আগে বারাকাহ তা জানতে পারেন। আগে থেকেই শোকাহত আমেনার এই খবর শোনা মাত্র শয্যাশায়ী হয়ে যায়। বারাকাহ ছাড়া বাড়ীতে আমিনার পাশে তখন দ্বিতীয় কোনো প্রাণী ছিলো না। আমেনার সেবা যত্ন, তাকে প্রবোধ দেয়া ও মনোবল দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা বারাকাহর জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে যায় এ ঘটনার পর থেকে।
এর বেশ কিছুদিন পর আমিনা যখন মুহাম্মাদ (সাঃ) কে প্রসব করেন তখনই বারাকাহই সর্বপ্রথম তাকে কোলে নেন৷ কিরকম সৌভাগ্যবান এই নারী যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এই বিশ্বের জন্য প্রেরিত রহমত গ্রহণ করার সম্মান অর্জন করলেন তিনি।
মক্কা উপত্যকার বাইরে মরুবাসী ধাত্রীরা পালনের জন্য শিশুদের নিতে আসতো। মুহাম্মাদ (সাঃ) দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান বিধায় দুগ্ধদাত্রীরা কেউ তাকে নিলো না। যারা প্রচুর টাকা দিতে সক্ষম, তাদের সন্তানদেরই তারা আগ্রহ ভরে নিলো। হালিমা সাদীয়া নাম্নী এক দুগ্ধদাত্রী সবার শেষে আসলো। কারণ, তার বাহন গাধীটি এতোই রোগা ও দুর্বল ছিলো যে তার মক্কাহ পৌঁছুতে বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো। অন্য কোনো শিশু না পেয়ে হালিমা মুহাম্মাদকে নিতে বাধ্য হলো। কিন্তু আল্লাহ্ পাকের কুদরত! ফেরার পথে হালিমার রোগা গাধীটি তেজী আরবী ঘোড়ার গতিতে বাড়ী ফিরলো মুহাম্মাদকে নিয়ে। তারপর এতীম শিশু মুহাম্মাদের ভাগ্যে হালিমার দৈন্যদশা দূর হয়ে গেলো। তার ভেড়া বকরির পাল মোটাসোটা হতে আরম্ভ করলো। প্রচুর দুধ দিতে লাগলো এবং দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে হালিমার ঘলর ভরে দিলো। চারি দিক থেকে হালিমার সংসারে বরকত লউপ্চে আসতে লাগলো।
এভাবে মুহাম্মাদ (সাঃ) ছ’বছর বয়সে পৌঁছালো। আমিনা সিদ্ধান্ত নিলো যে, সে তার স্বামী আব্দুল্লাহর কবর যিয়ারতের জন্য মাদীনাহ্ যাবে। এ সফর বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। শিশু মুহাম্মাদ ও শোকাহত আমিনাকে নিয়ে এ সফরে যাত্রা বারাকাহকে চিন্তিত করলো। কিন্তু আমিনা অটল সংকল্পের জন্য একদিন বারাকাহ, আমিনা ও মুহাম্মাদ উটের পিঠে এক পাল্কীতে চড়ে সিরিয়াগামী এক বিরাট কাফেলার সঙ্গী হয়ে মাদীনার পথে যাত্রা শুরু করলেন।
দূর্বল আমিনা আর শিশু মুহাম্মাদ সাঃ কে এক কঠিন পথ পারি দিয়ে বারাকাহ মদিনা পৌছালেন। কবর যিয়ারাত শেষে এখন মক্কায় ফেরার পালা। পথে আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়লো। তার জ্বর হলো। জ্বর দিন দিন বেড়ে এমন হলো যে, একদিন আমিনা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। তারা তখন মক্কাহ্ ও মাদীনার মাঝ পথে। “আব্ওয়া” নামক এক গাঁয়ের কাছে।তাদের জন্য জন্য কাফেলা একদিন দেরী করলো। কিন্তু আমিনার সুস্থ হয়ে উঠার কোনো লক্ষণ না দেখে কাফেলা তাদের রেখে চলে আসলো।
দিন রাত বারাকাহ একা আমিনার সেবা করছে আর শিশু মুহাম্মাদ সাঃ এর খেয়াল রাখছে। একরাতে আমিনার জ্বর প্রচন্ড বেড়ে গেল। আমিনার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। প্রতি মুহুর্তে যেনো বিদায়ের দিকে এগুচ্ছে। বারাকাহ অপলক দৃষ্টিতে আমিনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার সেবা করত, আর আগত বিপদের শঙ্কায় বিমূঢ় হয়ে যেত। এভাবেই একদিন আমিনা দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পরলেন বারাকাহ, তার সাথে কাঁদছেন শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)। এই অবস্থায় মুরুর বুকে আমিনার দাফন শেষ করে শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বুকে জড়িয়ে মক্কায় ফিরে এলেন বারাকাহ।
বারাকাহর জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ছিল অগাধ ভালোবাসা। তিনি বারকাহকে নিয়ে বলতেন "আমার মায়ের পর ইনিই আমার মা, আমার স্বজনদের অবশিষ্ট।" তিনি বলতেন বারাকাহ হচ্ছেন ধরার পৃষ্ঠে চলমান জান্নাত। মায়ের ভালবাসার পাশাপাশি রাসুল মুহাম্মাদ সাঃ এর প্রতি আরও বেশি ভালবাসা ছিল বারাকাহর। রাসূল সাঃ একবার সালাম করে বারাকাহকে বলেন, "আম্মা তুমি কেমন আছো?" উত্তরে বারাকাহ বলেন, "হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, আমি ভালো, যতক্ষণ ইসলাম ঠিক ঠাক থাকে।"
রাসূল (সাঃ) এর মক্কীজীবনের শেষ দিনগুলোতে, বিশেষ করে বিবি খাদিজা ও আবু তালিবের মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে মক্কার কাফেরদের ষড়যন্ত্রের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য রাসূল (সাঃ) বারাকাহ ও যায়দকে তাঁর সর্বপ্রথম গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব দেন। যায়দ ও বারাকাহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তা রাসূল (সাঃ) কে দারে আরক্বামে সরবরাহ করতেন। এক রাতে যখন কাফেররা দারে আরক্বামের চারপাশে অবরোধ দাঁড় করে কাছ দিয়ে কোনো লোককে যেতে দেখলেই তাকে ধরে বেদম প্রহার করতো, তখন এক গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ করে বারাকাহ দুর্গম পাহাড়ী পথে তার ছেলে রাসূল সঃ এর নিকট পৌঁছে তা সরবরাহ করেন। রাসূল (সাঃ) তা দেখে খুশী হয়ে বারাকাহর কপালে চুমো খেয়ে বলেন, “তোবা লাকি, ইয়া উম্মী, ওয়া ইন্না লাকি মাকানান ফিল জান্নাহ্।” অর্থাৎ “তোমার জুড়ি নেই আম্মা, তোমার জন্য অবশ্যই বেহেশ্তে বাড়ী তৈরী রয়েছে।” সুব্হানাল্লাহ্ এ হলেন বারাকাহ্, উম্মুর রাসূল (সাঃ)।
হুনাইনের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের অতর্কিত আক্রমণে যখন রাসুল (সাঃ) কে ফেলে নামকরা সাহাবীগণ পালিয়ে যাচ্ছিল তখন হাতেগোনা যেই কয়েকজন নিজের শরীর দিয়ে রাসুলকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিল তার মধ্যে বারাকাহ ছিল অন্যতম। সেখানে রাসুলকে লক্ষ করে ছোড়া এক বল্লমের সামনে বুক পেতে দেয় বারাকাহর এক পুত্র আইমান, যার কারণে তিনি উম্মে আইমান নামে পরিচিত ছিলেন। পুত্রে মৃত্যুতে শোকাতুর হলেও, তিনি বলেন আল্লাহর রাস্তায় কাজ করার জন্য এখনো তার দুই পুত্র জীবিত আছে।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাতের কিছুদিন পর, খলীফা আবু বকর এবং উমার বারাকাহর সাথে সাক্ষাতে যান। যেয়ে দেখেন বারাকাহ পুত্র হারানোর শোকের থেকে বেশী শোক করছেন এই বলে যে, "হায়, আসমান থেকে অহী আসার সংযোগ কেটে গিয়েছে।" এই ছিলেন বারাকাহ। এই ছিল তার তাওহীদের প্রতি ভালবাসা।
পিডিএফ ডাউনলোড করুন